চা-শ্রমিক সংঘের শ্রম উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি পেশ





নিজস্ব প্রতিবেদক::

বর্তমান বাজারদরের সাথে সংগতি রেখে ৬ সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণের খরচ হিসাব করে বাঁচার মত মজুরি ও পূর্ণাঙ্গ রেশন হিসেবে একটি পরিবারের প্রয়োজনের অনুপাতে সপ্তাহে চাল/আটা, ডাল, তেল, চিনি/গুড়, সাবান, কেরোসিন, জ্বালানি কাঠ ইত্যাদি প্রদান; প্রতি মাসে বিনামূল্যে ৫০০ গ্রাম চা-পাতা প্রদান; ক্ষেতের জমির জন্য রেশন কর্তন বন্ধ, দ্রব্য মূল্য কমানো, মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করে বার্ষিক ১৫% হারে ইনক্রিমেন্ট, মাসিক মজুরির সমপরিমান হারে বছরে দুইটি উৎসব বোনাস, সরকারি আইন মোতাবেক ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি ও ভাতা প্রদান, স্থায়ী-অস্থায়ী নির্বিশেষে সমকাজে সমমজুরি, ভূমির অধিকার প্রদান, চা-শিল্পে নৈমিত্তিক ছুটি (বছরে ১০ দিন) কার্যকর ও অর্জিত ছুটি প্রদানে বৈষম্যসহ শ্রম আইনের বৈষম্য নিরসন করে গণতান্ত্রিক শ্রমআইন প্রণয়ন এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনের মজুরি ও উৎসব বোনাস প্রদানে সকল অনিয়ম বন্ধ করে শ্রমআইন মোতাবেক নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক প্রদান, বন্ধ সকল চা-বাগান চালুসহ ১০ দফা দাবিতে অন্তবর্তী সরকারের শ্রম উপদেষ্টা বরাবর চা-শ্রমিক সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির পক্ষ থেকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।

২৪ আগস্ট রবিবার দুপুরে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের সাথে চা-শ্রমিক সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ দেখা করে স্মারকলিপি প্রদান করেন। জেলা প্রশাসক মোঃ ইসরাইল হোসেন স্মারকলিপি গ্রহণ করে চা-শ্রমিকদের দাবিসমূহ শ্রম উপদেষ্টাসহ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরে তা বাস্তবায়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন। স্মারকলিপি প্রদানের পূর্বে চা-শ্রমিক সংঘের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন দাবি সম্বলিত ফেস্টুন ও লাল পতাকা নিয়ে শহরের চৌমুহনা এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিল পরবর্তীতে চৌমুহনা এলাকায় চা-শ্রমিক সংঘের সহ-সভাপতি মধু রজকের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ অনুষ্টিত হয়। চা-শ্রমিক সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হরিনারায়ন হাজরার পরিচালানায় অনুষ্টিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস, রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোঃ সুহেল মিয়া, হোটেল শ্রমিকনেতা সুবেল মিয়া, চা-শ্রমিক সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নারী চা-শ্রমিকনেত্রী লক্ষীমনি বাক্তি, সহ-সাধারণ সম্পাদক সুভাষ গৌড়, প্রচার সম্পাদক কাজল হাজরা, প্রবীণ চা-শ্রমিকনেতা স্যামুয়েল বেগম্যান, সুনীল কর, হেমরাজ লোহার প্রমূখ।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, চা-শ্রমিকরা বংশ পরস্পরায় প্রায় ২০০ বছর যাবত চা-বাগানে বসবাস করে বনের বাঘ-ভাল¬ুক, সাপ-জোঁকসহ হিং¯্র জীবজন্তুকে মোকাবেলা করে অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে চা-শিল্পকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। অথচ ২০০ বছর পরও চা-শ্রমিকদের মজুরি ২০০ টাকা হয়নি। বর্তমান অগ্নিমূল্যের বাজারে চা-শ্রমিকদের মজুরি (সম্প্রতি ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট প্রদানের পর) সর্বোচ্চ ‘এ’ ক্লাস বাগানে দৈনিক ১৮৭.৪৩ টাকা এবং ‘বি’ ও ‘সি’ ক্লাস যথাক্রমে ১৮৬.৩২ টাকা এবং ১৮৫.২২ টাকা। দৈনিক ১৮৭.৪৩ টাকা মজুরি পাওয়ার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে গড়ে ২৩ কেজির কাঁচা পাতা উত্তোলন করতে হয়, নিরিখ পূর্ণ করতে না পারলে হিসেব করে প্রতি কেজির জন্য মজুরি কেটে রাখা হয়। অতীতে চা-শ্রমিকরা রেশন হিসেবে চাল, আটা, ডাল, চিনি/গুড়, লবন, সাবান, লাকড়ি, কেরোসিন ইত্যাদি পেয়ে থাকলেও বর্তমানে রেশন হিসেবে প্রতি সপ্তাহে একজন চা-শ্রমিককে ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম চাল বা আটা প্রদান করা হয়, যাদের ক্ষেতের জমি আছে তাদের রেশন হতে প্রতি বিঘায় বার্ষিক ১১২ কেজি চাল বা আটা কেটে রাখা হয়। বাংলাদেশে শিল্প সেক্টরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি পেয়ে থাকেন চা-শ্রমিকরা। নিম্নতম মজুরি বোর্ড কর্তৃক ঘোষিত ৪৩ টি সেক্টরে এবং মজুরি কমিশন ঘোষিত রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প সেক্টরের মজুরির সাথে তুলনা করলে চা-শ্রমিকদের মজুরি অত্যন্ত কম। অন্য সেক্টরের সাথে তুলনা করলে চা-বাগান মালিকদের পক্ষ থেকে ঘর, রেশন ও চিকিৎসা সুবিধার কথা তুলে ধরা হয়। বস্তুতঃ চা-শিল্পের প্রয়োজনেই চা-শ্রমিকদের বাগানে বসবাস করা জরুরি। চা-শ্রমিকদের বসবাসের জন্য দুই কক্ষ বিশিষ্ট ২২২ বর্গফুটের যে বাসা প্রদান করা হয় সেখানে রান্না ঘর পর্যন্ত থাকে না। ছেলে-মেয়ে বাবা-মাসহ এই দুই কক্ষের মধ্যে গাদাগাদি করে অমানবিক পরিবেশে চা-শ্রমিকদের বসবাস করতে হয়। প্রতিবেশি চা উৎপাদনকারী দেশসমূহের শ্রমিকদের মজুরির সাথে তুলনা করলে আমাদের দেশের চা-শ্রমিকদের মজুরি অত্যন্ত কম। প্রতিবেশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ০১ জুন ২০২৩ থেকে ২৫০ রুপি (৩৫০ টাকা), সিকিম রাজ্যে ১ জুলাই ২০২২ থেকে ৫০০ রুপি (৭০০ টাকা), শ্রীলঙ্কায় চা-শ্রমিকরা দৈনিক ১৭০০ রুপি (৬৮০ টাকা), নেপালে চা-শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১৫০০০ রুপি (১৩,০৫০ টাকা), চা-উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশ চীনে চা-শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ৩০০০ থেকে ৪,৫০০ ইউয়ান (৫০,৭৬০ টাকা থেকে ৭৬,১৪০ টাকা) পায়। এই সকল দেশেও চা-শ্রমিকরা মজুরিসহ সুযোগ-সুবিধাদি বৃদ্ধির দাবিতে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে আসছে।

আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির কারণে সরকারি কর্মচারীদের জন্য জুলাই ’২৫ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে এবং সরকারি কর্মচারী বেতন বৃদ্ধির জন্য নতুন পে-কমিশন গঠন করা হয়েছে। সরকারি হিসেবে কয়েক মাস পূর্বে মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছিল। বাজারদরে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার ঘোষিত মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশিই থাকে। শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০২৫ সালের শুরু থেকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে একজন শ্রমিকের দৈনিক পরিশ্রমের পর পরবর্তী দিন কাজে যোগদানের জন্য শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়োজনে দৈনিক তিন বেলা অতি সাধারণভাবে আহারের জন্য ২৫০/- (৫০+১০০+১০০) টাকা দিলেও পেট ভরে না। তাই স্ত্রী পুত্র কন্যাসহ মা-বাবাকে নিয়ে ৬ সদস্যের একটি পরিবারের জন্য দৈনিক ন্যূনতম ১,০০০/- টাকা দরকার। বাংলাদেশে ক্রিয়াশীয় জাতীয় শ্রমিক সংগঠনসমূহ জাতীয় ন্যূনতম মূল মজুরি ৩০ হাজার টাকা ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। তাই সামাগ্রিক বিচারে বর্তমান বাজারদর, মূল্যস্ফীতি, সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামো, মজুরি কমিশন ঘোষিত মজুরি, দেশের অপরাপর সেক্টরের শ্রমিকদের মজুরি এবং প্রতিবেশী নয়াঔপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ চা উৎপাদনকারী দেশের শ্রমিকদের প্রাপ্ত মজুরি পর্যালোচনা করে ৬ সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণের খরচ হিসাব করে বাঁচার মত মজুরি ও বার্ষিক ১৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট প্রদান করাসহ ১০ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য সমাবেশ থেকে জোর দাবি জানান হয়।